বাইজি মঙ্গল ১

আদ্যকথা

বাইজি বাইজি৷

শব্দটিতে সম্মান ও অসম্মান, মান এবং অপমান, শ্রদ্ধা আর ঘৃণার এক আশ্চর্য সহাবস্থান৷ বলা বাহুল্য, কথাটি বাংলা শব্দজাত নয়৷

রাজস্থানিতে বাই শব্দের মানে মা বা বোন, মারাঠিতেও বোন৷ ‘জি’ শব্দটি এই মা-বোনকে আরও সম্মানিত করেছে৷ এক দেশের গালি, অন্য দেশের বুলি৷ হিন্দিতে যা ‘পচেগা’ (রান্না) বাংলায় তা পচে যায়৷ বাংলায় যে রুই মাছ খাওয়ার বস্তু, উত্তরপ্রদেশে তা পেতে শোওয়া, গায়ে দেওয়ার ‘তুলো’৷ রাজস্থান বা মহারাষ্ট্রে যে নারী মাতৃকল্প বা ভগ্নীসমা, বাংলায় তারাই সমাজে অধঃপতিতা৷ বাঙালি নারী একসময়ে ভাবতেই পারতেন না তাঁরা পরপুরুষের সামনে বের হবেন, তাঁদের সামনে এসে শরীর দুলিয়ে নাচবেন বা গলা ফুলিয়ে গান গাইবেন— এ তো স্বপ্নেও ভাবার বিষয় ছিল না৷ কোন্‌ দেশ থেকে ‘বেহায়া’, ‘দু-কানকাটা’ ‘বেবুশ্যে’গুলো এসে দেশটাকে রসাতলে দিলে৷ ‘কলিতে আর ক-টা কি হবে ছারপোকাতে ছাতা ধরে বরগিতলা যাবে’— তাই হলো গো কলিকালে৷ মেয়েদের আর মানসম্মান থাকবে না৷ একে থিয়েটার এসে দেশটাকে গোল্লায় দিলে‍— ভদরনোকের সঙ্গে হাড়কাটা গলির বেবুশ্যগেুলো এসে সমাজটার কী হালটাই না করে ছেড়েছে!

আসলে অর্থম্ অনর্থম্৷ হঠাৎ করে বেহিসেবি টাকা-পয়সা এসে গেলে তা সৎপথে ব্যয় করার পরিকল্পনা মাথাতেই আসে না৷ তার চেয়ে যে সব শখ-আহ্লাদ জীবনে মেটানো যাবে না, সেটাতেই টাকা ঢালাটা সহজ৷ আর এই শখ মেটাতে গেলে মদ আর মেয়েমানুষের চেয়ে সেরা রসদ আর কী থাকতে পারে৷ তো হঠাৎ করে বেশ কিছু টাকা বাঙালির ঘরে এসে গেল পলাশির যুদ্ধের পরে পরেই! ‘বাঙালির খুনে লাল হল যত ক্লাইভের খঞ্জর’— নবীনচন্দ্র সেই কবেই তাঁর ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যে লিখে গিয়েছেন৷ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজকে মেরে ফেলা হল৷ মিরজাফরের দোষ দিলে সবাই৷ সব পাখিতেই মাছ খায় মাছরাঙার নাম হয়৷ নইলে জগৎশেঠ, নবকৃষ্ণ দেবরা কি কিছু কম বিশ্বাসঘাতক আর অপরাধী ছিলেন! আঙুল ফুলে কলাগাছ হলো— সিরাজের পতন হল আর তাঁর লুকনো টাকা লুঠে নিযে নবকৃষ্ণদেব ‘মহারাজা’ হয়ে উঠলেন৷ একটা হঠাৎ নবাবের জাত গড়ে উঠল৷ জাতে উঠবার জন্য তাদের দুটো কাজ— বড়লোকি দেখানো আর ইংরেজের পা-চাটা৷ আখের গোছাতে গেলে এটা করতেই হয়৷ তাতে বাঙালির যদি সর্বনাশ হয়, হোক না৷ তো তাই হল৷ আগ্রা-লখনউ-রাজস্থান থেকে বাইজিদের আনা হল— তাঁদের ভাষায় ‘তওয়াইফ’— তাঁরা এলেন৷ এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন৷ উনিশ শতকের গোড়া থেকে বছর তিরিশেক চুঁটিয়ে রাজত্ব করলেন তাঁরা৷ তারপরে ভাটা কয়েক বছরের৷ আবার জাগা৷ তারপরে ক্ষয়৷ বাইজিরা নিজেরাই সম্মান নষ্ট করলেন৷ কোনওদিনই বাঙালি তাঁদের মা-বোন হিসেবে দেখেনি৷ তবুও সমাজে না হোক, মজলিসে একটা সম্ব্রম ছিল৷ এখন সবই তা ভ্রম৷ বাইরের ঘুণ ধরা ঠাট আর বজায় রাখা দায়৷ প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের গণিকালয়ে সরাসরি তাঁরা থাকলেন না বটে‍— কিন্তু আশেপাশে তো বটেই তাঁদের ডেরা৷ নামে বাইজি, কামে বেশ্যা৷ একটা হক কথা বলেছি‍লেন বটে‍ এক পানের দোকানওয়ালা৷ বলেছিলেন, কেউ আর নাচ দেখতে‍ ঠুংরি শুনতে তাঁদের কাছে যায় না— আসল কথাটি হল ‘সেক্স’, ওটিই সার৷ তাহলে আর নলচে আড়াল করে হুঁকো খেয়ে কী লাভ!

তো সে‍-সব লাভ-লোকসানের কথা থাক৷ আগে লাভের কথাটি বলে নিই৷ কলকাতার বাইরে মুর্শিদাবাদ আর তার সন্নিহিত অঞ্চলে বাইজিরা কদর পেযেছি‍লেন বটে, তবে‍ কলকাতার মতো নয়৷ শোনা যায়, নদিযার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই নাকি দুর্গাপুজোতে প্রথম বাই নাচের আয়োজন করেন৷ শোনা কথাই সম্ভবত, নইলে ভারতচন্দ্র তার সবিস্তার উল্লেখ করে বসতেন৷ প্রথম-দ্বিতীয়র হিসেব করে লাভ নেই— উইনার্স বা রানার্স আপের কাপ তাঁদের জুটেছিল কিনা আমরা জানি না৷ তবে কেউ তো একজন হোতা ছিলেনই৷ ১৮১৮ সালের আগে বাংলা সাময়িকপত্র ছিল না৷ তবুও অনুমান করি এর আগে থেকেই বাইজিরা কলকাতায় ঢুকতে আরম্ভ করেছিলেন এবং খুব বাড়াবাড়ি না করলেও রামমোহন রায় উদ্গাতাদের মধ্যে যে একজন ছিলেন সন্দেহ নেই৷ রংপুর থেকে ডিগবির এই দেওয়ান কলকাতায় আসেন ১৮১৫ সাল নাগাদ৷ এবং ১৮১৯ সালের ১৬ অক্টোবর ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা লিখছে‍— ‘নর্ত্তকী৷— শহর কলিকাতায় নিকী নামে এক প্রধান নর্ত্তকী ছিল৷ কোন ভাগ্যবান লোক তাহার গান শুনিয়া ও নৃত্য দেখিয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া এক হাজার টাকা মাসে বেতন দিয়া তাহাকে চাকর রাখিয়াছেন৷’

কে এই ‘ভাগ্যবান’ যিনি চাকরের জন্য মাসে হাজার টাকা বেতন দিতে পারেন৷ অনেকেই জানেন রামমোহন তাঁর বাগানবাড়িতে নিকিকে নাচ করার জন্য আহ্বান করেছিলেন এবং নিকি সম্ভবত তাঁর বাগানবাড়িতে থাকতেনও৷ শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর অপ্রকাশিত ডায়েরির এক জায়গায় লিখে গেছেন, —‘যেদিন হইতে জানিলাম তাঁহার যবনী উপপত্নী ছিল— সেইদিন হইতে তাঁহার প্রতি আমার শ্রদ্ধা দশ ডিগ্রী কমিয়া গিয়েছে৷’ এবং অনেকে বলেন সেখ বক্স নামে রামমোহনের একটি পুত্রসন্তান ছিলেন যিনি এই যবনী উপপত্নী-গর্ভজাত৷ এ নিয়ে বিতর্ক আছে‍— আমরা সে পথে যাচ্ছি না৷

রাজা রামমোহন রায়

কিন্তু ‘সমাচার দর্পণ’-এর এই ছোট্ট সংবাদ থেকে জানতে পেরেছি, নিকি ছিলেন কলকাতার এক ‘প্রধান নর্তকী’৷ তার মধ্যে অনেক ‘অপ্রধান’ বাইজি এই সময়ের মধ্যে কলকাতায় এসে ঠাঁই পেয়ে গেছেন৷ ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে‍ মুদ্রিত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবুবিলাস’ বইটিতে দ্বিতীয় খণ্ডের তৃতীয় উপদেশটি ছিল এই ভাষায় রচিত— ‘তৃতীয় উপদেশ৷ প্রতি রবিবার বাগানে যাইবা মৎস্য ধরিবা সকের যাত্রা শুনিবা নামজাদা নামজাদা বেশ্যা ও বাই ইহারদিগের নিমন্ত্রণ করিয়া বাগানে আনাইবা বহুমূল্য বস্ত্র হার হীরকাঙ্গুরীয়ক অর্থাৎ হীরার আংটি ইত্যাদি প্রদান করিবা…৷’

ইনি ‘বেশ্যা’ এবং ‘বাই’ পৃথক শ্রেণিভুক্ত করেছেন, তবে মর্যাদার ক্ষেত্রে‍ সমশ্রেণিভুক্ত ভেবেছেন বলেই মনে হয়৷ ১৮২০ সালে গেরেটিতে একটা বড় নাচঘর খুব পুরনো হওয়ায় ভেঙে নতুন করে গড়ার খবর পড়ে মনে হচ্ছে তারাশঙ্করের জলসাঘরের অস্তিত্ব অনেক পুরনোই৷ জলসাঘর মানেই নাচ, নাচ মানেই গণিকা বা বাই—‘সে সময়ে তো অবশ্য‍ই৷ দ্বারকানাথ ঠাকুর বেলগাছিয়ায় বাগানবাড়ি তৈরি করেন দু’লক্ষ টাকা খরচ করে৷ এমন বাগানবাড়ি সেকালের কলকাতায় ছিল না৷ এখানে একাধিক ভোজের কথা আমরা জেনেছি, কিন্তু এখানে বাইনাচের খবর পাইনি৷ পেয়েছি মহানাচের খবর৷ ‘মহানাচ’ কি ‘বলনাচ’? নাকি…!

‘নববাবুবিলাস’-এর একটি কবিতা একালের পাঠকের জন্য উদ্ধার করি:

কেহ বলে বড় মজা ওহে বাবু তুমি ইয়ারের রাজা

কেহ বলে মেদরা বুঝি অল্প আসিয়াছিল,

হিঙ্গন বিবি বসাক বাবু এই দুইজনে সকলি খাইল,

কেহ ঘরে ঢুকিল কার্ক খুলিয়া সরাপ ছয়লাপ করিল,

কেহ মৎস্য ধরে গুপ্ত ঘরে, কেহ মজিয়াছে কালোয়াতের গানে,

কেহ বেশ্যামুখ চুম্বনে, কেহ আলিঙ্গনে, কেহ স্তনমর্দ্দনে‍

কেহ বলে তয়ফাওয়ালি কি মজা দিলি৷

এখানে দুটি শব্দের দিকে আমাদের নজর গেছে‍—‘হিঙ্গন বিবি’ এবং ‘তয়ফাওয়ালি’৷ দুটিই বাইজির সঙ্গে জড়িত শব্দ৷ নিকির কথা আমরা বলে এসেছি‍— সে ছিল কলকাতার সেরা নাচনি৷ ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ক্যালকাটা জার্নালে’ বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয় যে, সে বছর পুজোর সময় নিকি মহারাজা রামচন্দ্র রায় ও বাবু নীলমণি ও বোষ্টমদাস মল্লিকের বাড়িতে বাবুদের অতিথিদের নাচ-গানে আপ্যায়িত করবেন৷ ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে নিকির সৌভাগ্য হয়েছিল রামমোহনের মানিকতলার বাগানবাড়িতে নাচ-গান করবার৷ শ্রোতারা তাঁর গানে-নাচে মশগুল হয়ে থাকতেন৷ কিন্তু সুরেলা কণ্ঠ, লাস্য আর প্রাণকাড়া নৃত্যভঙ্গিমায় সেকালে আর সব তয়ফাওয়ালিদের মধ্যে সেরা ছিলেন নাম্নিজান, সুপনজানদের সঙ্গে অবশ্যই হিঙ্গনবাই এবং এঁরা সবাই ছিলেন তয়ফাওয়ালি৷ শেষের দিকে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন হীরা বুলবুল আর শ্রীজান৷ ধনী বাবুরা তাঁদের সম্মান দিতেন৷ তাঁদের নিয়ে আসার জন্য পালকি পাঠিয়ে দিতেন; পালকির সঙ্গে যেত পাইক-বরকন্দাজরা৷ বেহারারা বাইজিকে নিয়ে এসে জলসাঘরের সংলগ্ন নাটমন্দিরে নামিয়ে দিতেন৷ হিমপো হিমপো শব্দ শুনেই উন্মুখ ‘রাজাবাবু’ নিজে আসতেন এগিয়ে৷ সম্মিত আননে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে চোখদুটো তাঁদে‍র একটু কুঁচকে‍ যেত— তাকে বোধ করি কামদৃষ্টি বলাই ভাল৷ এবারে পালকির দরজা খুলে যেত আর নেমে আসতেন বাই-জি‍— পেটিকোট, ওড়না, গা-জোড়া গয়না আর কামদিঠি নয়না নিয়ে৷ বাবু গিয়ে আহ্বান জানাতেন—‘এসো বিবিজান’—বিবিজান এসে যান লবেজান করে৷

হিঙ্গনবাইয়ের গানের রেকর্ড

 

যদি বেগমজান আসতেন— সাহেবরা পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে তাঁকে‍ সম্মান জানাতেন৷ বেগমজানের আদি ঠিকানা জানা যায়নি, কিন্তু হিঙ্গনকে ‘লোকাল’ মেয়ে বলা যায়৷ তিনি কলকাতায় এসেছিলেন বর্ধমান থেকে৷ অদ্ভুত সুরেলা গলা আর ‘কালোহরিণ চোখ’ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হিঙ্গন নাচঘরের প্রাঙ্গণে দর্শকদের শরীর-মনের শিরীষশাখায় দোল লাগাতেন৷ তবে নিকিকে‍ আনা নিয়ে যতটা রেষারেষি ছিল ততটা বোধ করি আর কাউকে নিয়ে নেই৷

আসলে প্রতিযোগিতা ছিল শুধুমাত্র সেরা বাইজিটিকে আসরে আনার জন্যেই শুধু নয়, প্রতিযোগিতা ছিল কোন্ গণ্যমান্য সাহেবকে সেই সুযোগে ধরে আনা যায়৷ তাতেই তো তাঁর বরাত খুলে যাবে৷ ২২ নভেম্বর ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে একটা সমাচার উদ্ধার করি চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জনের জন্য— ‘…নাচ৷৷— গত সোমবার ৩ অগ্রহায়ণ শ্রীযুতবাবু রূপলাল মল্লিকের বাটীতে রাসলীলা সময়ে নাচ হইয়াছিল তাহার বিবরণ৷ দিনেক দুই দিন পুর্ব্বে সাহেব লোকেরদিগের নিকটে টিকীট অর্থাৎ নিমন্ত্রণ পত্র পাঠান গিয়াছিল তাহাতে নিমন্ত্রিত সাহেবরা তদ্দিনে নয় ঘণ্টার কালে আসিতে আরম্ভ করিয়া এগার ঘণ্টা পর্য্যন্ত সকলের আগমনেতে নাচঘর পরিপূর্ণ হইল এবং নাচঘরের সৌন্দর্য্য যে করিয়াছিলেন সে অনির্ব্বচনীয়৷ অনন্তর ক-এক তারকা নর্ত্তকীরা সেই সভাতে অধিষ্ঠানপূর্ব্বক নৃত্য করিতে লাগিল ইহাতে তদ্বিষয়ে রসিকেরা অত্যন্ত তুষ্টি প্রকাশ করিলেন৷ এবং তাহার নীচের তালাতে চারি সেজ সাজাইয়া নানাবিধ খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুত করিয়া সেজ পরিপূর্ণ করিয়াছিল তাহাতে সাহেবরা তৃপ্ত হইলেন এবং মদিরা পান দ্বারা সকলেই আমোদিত হইলেন এবং বাদশাহী পল্টনের বাদ্যকরেরা অনুরাগে নানা রাগে বাদ্য করিল তাহাতে কোন শ্রোতা ব্যক্তির মনোহরণ না হইল৷ সকলে কহে যে এমন নাচ বাবুরদের ঘরে আর কোথাও হয় নাই৷…’

লর্ড ক্লাইভ পর্যন্ত বাইজিদের হাত ধরে টানাটানি শুরু করেছিলেন৷ শাসক ইংরেজের দল এই বেলেল্লাপনা একেবারেই বরদাস্ত করতে রাজি ছিলেন না৷ তাঁরা এই অসংযমে একটা রাশ টানতে চাইলেন, তাতেই পাশ হয়ে গেল একটা অ্যান্টি‍-বাইজি কানুন৷ সাহেবরা এদেশে আসতেন, তাঁদের মেমরা থাকতেন দূর ইংল্যান্ডে৷ স্বভাবতই তাঁদের শরীরী চাহিদা এমনি করেই মেটাতে চাইতেন৷ এখন বিবিরাও সব এদেশে আসতে শুরু করলেন— শূন্যস্থানও পূরণ হতে লাগল৷ তাতেই ১৮৩০-এর কাছাকাছি থেকে বাই-মুজরোতে বড় একটা ধাক্কা লাগল৷

আমরা দেখলাম রাসযাত্রার সময়েও বাইনাচের আয়োজন হতো৷ এমনি চড়কের সময়েও৷ তবে আসল মজাটা হতো দুর্গাপুজোর সময়েই৷ চড়কে বাইনাচ দেখেছিলেন৷ বিলেত থেকে আসা শ্রীমতী ফ্যানি পার্কস৷ তিনি যা লিখেছেন তা বিনয় ঘোষ মহাশয়ের তর্জমায় এমনটিই দাঁড়িয়েছিল:

‘নীচজাতের হিন্দুরা শুনেছি‍ চড়কপূজার অত্যন্ত ভক্ত৷… এরকম একটা পৈশাচিক ভয়াবহ উৎসব আর কোথাও দেখিনি৷… ধনী লোকেরা টাকাপয়সা দিয়ে গাজনের সন্ন্যাসীদের চড়ককাঠে চরকিপাক খাওয়ান পুণ্যার্জনের জন্য৷ এইভাবে প্রকসি দিয়েও নাকি পুণ্যলাভ করা যায়৷

উৎসবে ছ্যাকরাগাড়ি ভর্তি হয়ে বাইজিরাও এসেছিল অনেক৷ যেমন তাদের পোশাক, তেমনি নাচগানের ভঙ্গি৷ যাঁর রুচি আছে তাঁর পক্ষে বরদাস্ত করা কঠিন৷ কিন্তু এই বাইজিনাচ দেখার জন্য বহু হিন্দু ভদ্রলোকের ভিড় হয়েছিল উৎসবে৷

১৮২২ সালের নভেম্বর মাসে তিনি (ফ্যানি পার্কস) এদেশে বেড়াতে এসে এইসব নাচ দেখেছিলেন৷ তবে রামমোহন রায়ের বাগানবাড়িতে নিকি বাইজির বাইনাচ তাঁকে‍ খুব মাতিয়েছিল৷ তিনি লিখে গেছেন— একদিন এক ধনিক সম্ভ্রান্ত বাঙালিবাবুর বাড়ি ভোজসভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম৷ বাবুর নাম রামমোহন রায়৷ বেশ বড় চৌহদ্দির মধ্যে তাঁর বাড়ি, ভোজের দিন নানা বর্ণের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল৷ চমৎকার আতসবাজির খেলাও হয়েছিল সেদিন৷ আলোয় আলোকিত হয়েছিল তাঁর বাড়ি৷

বাড়িতে বড় বড় ঘর ছিল এবং একাধিক ঘরে বাইজি ও নর্তকীদের নাচগান হচ্ছিল৷ বাইজিদের পরনে ছিল ঘাঘরা, সাদা ও রঙিন মসলিনের ফ্রিল দেওয়া, তার উপর সোনারুপোর জরির কাজ করা৷ সার্টিনের ঢিলে পায়জামা দিয়ে পা পর্যন্ত ঢাকা৷ দেখতে অপূর্ব সুন্দরী, পোশাকে ও আলোয় আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল৷ গায়েতে অরংকার ছিল নানারকমের৷ তারা নাচছিল দল বেঁধে‍ বৃত্তাকারে, পায়ের নূপুরের ঝুম-ঝুম শব্দের তালে তালে৷ নাচের সময় মুখের, গ্রীবার ও চোখের ভাব প্রকাশের তির্যক ভঙ্গিমা এত মাদকতাপূর্ণ মনে হচ্ছিল যে তা বর্ণনা করতে পারব না৷ নর্তকীদের সঙ্গে একদল বাজিয়ে ছিল – সারেঙ্গি, মৃদঙ্গ, তবলা ইত্যাদি নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিল তারা৷

গানের সুর ও ভঙ্গি সম্পূর্ণ অন্যরকম, আমরা শুনিনি কখনও৷ মধ্যে মধ্যে মনে হয় সুর কণ্ঠ থেকে নির্গত না হয়ে নাসিকার গহ্বর থেকে তরঙ্গায়িত হয়ে আসছে৷ কোনও কোনও সুর এত সূক্ষ্ণ ও মিহি যে কণ্ঠের কেরামতির কথা ভেবে অবাক হয়ে যেতে হয়৷ বাইজিদের মধ্যে একজনের নাম নিকি, শুনেছি সারা প্রাচ্যের বাইজিদের মহারানি সে, এবং তার নাচ-গান শুনতে পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের কথা৷

এই নিকি কলকাতায় এসেছিল ১৮০৮ সাল নাগাদ৷ এই সালের ৬ অক্টোবর ছিল দুর্গাপুজোর তারিখ৷ মহারাজ নবকৃষ্ণের ছেলে রাজকৃষ্ণ শোভাবাজার রাজবাড়ির নতুন মহলে বাইনাচের মুজরো বসিয়েছিলেন৷ সাহেবদের নেমন্তন্নও সেই শুরু৷ লর্ড মিন্টো এসেছিলেন এই আসরে নিমন্ত্রিত হয়ে৷ নিকির আবির্ভাব এই আসরেই৷ এই রাজকৃষ্ণের সঙ্গে পাল্লা দিতেন চূড়ামণি দত্তের ছেলে কালীপ্রসাদ দত্ত— যাকে নিয়ে বিখ্যাত ‘কালীপ্রসাদী হাঙ্গামা’ গড়ে ওঠে৷ এই সময় রাজকৃষ্ণ আবার করে মজলিশ বসিয়ে নিকিকে দিয়ে বাই নাচাচ্ছেন শুনে কালীপ্রসাদ রেগে লাল৷ রাজকৃষ্ণ চার-পাঁচ দল বাইজিদের নেমন্তন্ন করেছেন— স্বচক্ষে দেখেছিলেন সামরিক অফিসার ফ্রেডরিস উইন৷ এঁদের মধ্যে নিকিও ছিলেন৷ চতুর্দশী এই কিশোরীকে তাঁর মনে হয়েছিল ‘স্বয়ং রতি দেবী তাঁকে‍ নির্মাণ করেছিলেন৷’ তিনদিন ধরে এখানে নেচে নিকি বারোশো টাকা রোজগার করেন, রাজা খুশি হয়ে তাঁকে‍ দু’জোড়া শাল উপহার দেন— তার দামও প্রায় হাজার-বারোশো৷

শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় বাইজি নাচের আসরে উপস্থিত ব্রিটিশ রাজপুরুষ

 

নিকি নেচেছিলেন আর যাঁদের বাড়িতে তাঁদের মধ্যে ছিলেন কিষানচন্দ্র রায় (১৮১৪), রামচন্দ্র রায় (১৮১৫ এবং ১৮১৯), আশুতোষ দেব (১৮০২) প্রভৃতি৷ নিকির সময় খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন বাইজি আশরুন এবং নুরবক্স৷ আশরুন নেচেচিলেন যাঁদের বাড়িতে তাঁদের মধ্যে রামচন্দ্র রায়ও ছিলেন৷ রতনবাই একটু পরে, চুন্নুও তাই৷ তবে চুন্নু সৌন্দর্যে আর সবাইকে টেক্কা দিতেন৷ নিকির বাজার তখন পড়তি৷ চুন্নুকে নিযে বাবুদের দর যেন নিলামে চড়ত৷ পঁচিশ হাজার পর্যন্ত দর উঠেছিল তাঁর৷ এত দর কোনও বাইজি কস্মিনকালেও পাননি৷ কাশ্মীরি সুন্দরী চুন্নুকে নাচিয়ে নাম কুড়িয়েছিলেন রূপচাঁদ রায় ১৮১৯ সালে৷ বেনারস থেকে আনা তুলসীবাইকে নিজের আসরে নাচিয়ে বাজার মাত করেছিলেন জয়কৃষ্ণ রায় দুর্গাপুজোর কোনও এক রাতে৷ জোড়াসাঁকোর জমিদার বৈদ্যনাথ রায়ের বাড়িতে নাচের আসর জমিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশ থেকে‍ আসা জিনাত বাই৷ তবে এই সব হুজ্জোতির মধ্যে বাজার গরম করে দিয়েছিলেন কলুটোলার নগেন সরকার আর খগেন সরকার৷ সম্পর্কে এঁরা বাপ-বেটা৷ দু’জনেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুৎসুদ্দি৷ এন্তার পয়সা করেছেন দু’জনেই৷কলকাতায় তখন নাচের বাজার মাত করে রেকেছেন দুই বাইজি‍— সুপানজান আর নান্নিজান৷ বাপ বলছেন— আমি এদের নাচাব, ছেলে বলেন— আমি৷ একবার যদি ইনি সুপানকে আনান তো উনি নান্নিকে৷ পরের বার ইনি‍-উনিদের বাই বদল হয়৷ সে কেচ্ছা বাপ-বেটাতে বাই নাচানো নিয়ে৷ ‘নগেন-খগেন’-এর লড়াই তখন কলকাতার আলোচ্য বিষয়সমূহের সেরা বিষয়৷ এর পরে বাই আসরে এসে গেলেন গওহর জান—‘ইন্ডিয়ান নাইটিঙ্গেল’— যাঁর কথা আমরা আলাদা করে বলব৷ যাকে নিয়ে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন এক বঙ্গসন্তান— ভূপেন্দ্রনাথ ঘোষ—‘পাথুরিয়াঘাটার জমিদার৷ এর কথা আমরা একটু বিস্তারিতভাবে বলার অবকাশ নেব একটু পরে৷

কিন্তু এক সময়ে এই বাইজি বাহারের চমক কমে গেল৷ বাইজিনাচে যৌনতৃপ্তি বাবুদের কতখানি হতো তা নিযে বাবু-বিবি কেউ কোনও সাবুদ রেখে যাননি৷ কিন্তু ছোটবাবুরা যে বড়বাবু হতে চান, আর বড়বাবুরা যে আরও বড়বাবু— তার পিছনে ছিল সাহেব তোষণের ব্যাপার৷ লর্ড ক্লাইভ পর্যন্ত বাইজিদের হাত ধরে টানাটানি শুরু করেছিলেন৷ শাসক ইংরেজের দল এই বেলেল্লাপনা একেবারেই বরদাস্ত করতে রাজি ছিলেন না৷ তাঁরা এই অসংযমে একটা রাশ টানতে চাইলেন, তাতেই পাশ হয়ে গেল একটা অ্যান্টি‍-বাইজি কানুন৷ সাহেবরা এদেশে আসতেন, তাঁদের মেমরা থাকতেন দূর ইংল্যান্ডে৷ স্বভাবতই তাঁদের শরীরী চাহিদা এমনি করেই মেটাতে চাইতেন৷ এখন বিবিরাও সব এদেশে আসতে শুরু করলেন— শূন্যস্থানও পূরণ হতে লাগল৷ তাতেই ১৮৩০-এর কাছাকাছি থেকে বাই-মুজরোতে বড় একটা ধাক্কা লাগল৷ ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা এই নিযে‍ একটি সবিস্তার প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল, এর ১৭ অক্টোবর ১৮২৯, ২ কার্তিক ১২৩৬ তারিখে প্রকাশিত সংখ্যাটিতে৷ এটি আমরা হুবহু তুলে দিচ্ছি— কেন বাইনাচের রমরমায় ঘাটতি পড়ে গেল তার একটি সত্য কারণ জানতে পারবেন পাঠক— তাই৷

‘…শারদীয়া পূজা৷ – এই দুর্গোৎসব এখন সমাপ্ত হইয়াছে এবং সমস্ত দেশে পুনর্ব্বার কর্ম্মকার্য্য আরম্ভ হইয়াছে৷ সকলেই কহেন ইহার পূর্ব্বে এই দুর্গোৎসবে যেরূপ সমারোহপূর্ব্বক নৃত্যগীত ইত্যাদি হইত এক্ষণে বৎসর ২ ক্রমে ঐ সমারোহ ইত্যাদির হ্রাস হইয়া আসিতেছে৷ এই বৎসরে এই দুর্গোৎসবে নৃত্যগীতাদিতে যে প্রকার সমারোহ হইয়াছে ইহার পূর্ব্বে ইহার পাঁচ গুণ ঘটা হইত এমত আমাদের স্মরণে আইসে৷ কলিকাতাস্থ ইঙ্গরেজী সমাচারপত্রে ইহার নানা কারণ দর্শান গিয়াছে বিশেষতঃ জানবুল সমাচারপত্রে প্রকাশ হয় যে কলিকাতাস্থ এতদ্দেশীয় ভাগ্যবান লোকেরা আপনারাই কহেন যে এক্ষণে সাহেবলোকেরা বড় তামাসার বিষয়ে আমোদ করেন না৷ এপ্রযুক্ত যে হ্রাস হইয়াছে ইহা প্রত্যক্ষ প্রমাণ৷ঐ পত্রপ্রকাশক আরো লেখেন, হইতে পারে যে এতদ্দেশীয় ভাগ্যবান লোকেদের আপনাদের টাকা এইরূপে সমারোহেতে মিথ্যা নষ্ট করা অনুচিত হইতে পারে যে কাহারো ২ তাদৃক্‌ ধন এখন নাই৷ গত কতক বৎসর হইল নাচের বিষয়ে যে অখ্যাতি হইয়াছে ইহা সকলেই স্বীকার করেন ঐ নাচের সময়ে কএক বৎসরাবধি অতিশয় লজ্জাকর ব্যাপার হইত এবং যে ইংগ্লণ্ডীয়েরা সে স্থানে একত্রিত হইতেন তাঁহারা সাধারণ এবং মদ্যপানকরণে আপনাদের ইন্দ্রিয় দমনে অক্ষম৷

অতএব এই উৎসবের যে শোভা হইত তাহা রাহুগ্রস্ত হইয়াছে ইহাতে কোন সন্দেহ নাই৷ ইহার অনেক কারণ দর্শান যায়৷ কলিকাতাস্থ অনেক বড় ২ ঘর এখন দরিদ্র হইয়া গিয়াছে যাঁহারা ইহার পূর্ব্বে মহাবাবু এবং সকল লোকের মধ্যে অতিশয় প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁহারদের মধ্যে অনেকেরি এখন সেই নামমাত্র আছে৷ কেহ সুপ্রিম কোর্টে মোকদ্দমাকরণেতে নিঃস্ব হইয়াছেন কেহবা অধিকারের যে অংশকরণেতে বাঙ্গালিরা ক্রমে২ হ্রাস প্রাপ্ত হন তাহাকরণে নির্ধন হইয়া গিয়াছেন৷ এতদ্দেশে পূজা ও বিবাহ ও শ্রাদ্ধ এই তিন ব্যাপার টাকা ব্যয়ের প্রধান কারণ এবং ইহাতে অনেকে দরিদ্র হইয়া যান বিশেষতঃ এই তিন ব্যাপারে সুখ্যাতি প্রাপণার্থে এমত অপরিমিতরূপে ব্যয় করেন যে তাহাতে ঋণেতে একেবারে ডুবিয়া গিয়া পুনর্ব্বার ঐ সকল ব্যাপারকরণে অক্ষম হন৷ উৎসবের হ্রাসহওনের আরো এক কারণ এই যে জ্ঞানবৃদ্ধি৷ হিন্দুশাস্ত্রে লেখে যে যাঁহারা জ্ঞানকাণ্ডে আসক্ত তাঁহারা কর্ম্মকাণ্ডে অনাসক্ত কলিকাতাস্থ মান্য লোকেরদের মধ্যে এখন বিদ্যার অতিশয় অনুশীলন হইতেছে এইপ্রযুক্ত বহুব্যয়সাধ্য যে কর্ম্মেতে মানসিক সন্তোষ অল্প এবং বহুসম্পত্তির নাশ এমত কর্ম্মেতে লোকেরা প্রবৃত্ত হন না৷

সমারোহপূর্ব্বক এই উৎসবকরণ অল্প কাল হইয়াছে এবং তাহা প্রায় কেবল বঙ্গ দেশেই হইয়া থাকে৷ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় প্রথমতঃ এই উৎসবে বড় জাঁকজমক করেন এবং তাঁহার ঐ ব্যাপার দেখিয়া ক্রমে২ ব্রিটিস গবর্ণমেন্টের আমলে যাঁহারা ধনশালী হইলেন তাঁহারা আপনাদের দেশাধিপতির সম‍ক্ষে ধন সম্পত্তি দর্শাইতে পূর্ব্বমত ভীত না হওয়াতে তদ্দৃষ্টে এই সকল ব্যাপারে অধিক টাকা ব্যয় করিতেছেন৷…’ (বানান অপরিবর্তিত)

নৌটঙ্কি— নাচনির দল

আসর, বাসর, জলসাঘর নিয়ে বাইজিদের যে জীবন তার সঙ্গে সাধারণভাবে এই পরিচয় আমাদের হয়ে গেছে৷ এ নিয়ে কিংবদন্তি গড়ে উঠেছে, একটা আবছা পদর্গার আবরণের জীবনে আমরা অনেকবার উঁকি দিয়েছি৷ যদি জানা জীবনের আড়ালে আরও কিছু জানতে পারি৷ যেটা জেনেছি সেটা একটা মোহময় জীবন, একটা বিলাস, বিপুল-অপ্রতুল অর্থবিগলন, একটা শিল্পিত অনাচার, একটা শরীরী আবেদন— একটা দেখতে পাওয়া সহজে‍-না-ছোঁওয়া ভুবনের গড়ন-নড়ন এবং চড়নের আপাত রঙিন ছবি আমরা দেখছিলাম৷

কোনও এক সময়ে এক বিজ্ঞানী একটি জাগতিক সত্যকে বিজ্ঞানের ভাষায় রূপায়িত করেছিলেন— to every action there is an equal and opposite reaction— প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি সমান এবং বিপ্রতীপ প্রতিক্রিয়া থাকে৷ এই যে বাইজি সমাজ, এদের অবস্থান থেকে অনেকটা সরে এসেই এমনই নাচ-গান-পুরুষ নিয়ে ভারতীয় সমাজে আরও অনেকদল গড়ে উঠেছিল যাঁরা নামে বাইজি নন, কিন্তু বাইজিও কি নন?— এমন প্রশ্নের মধ্যে আসীন৷ আমাদের মনে পড়ছে অন্তত দুটো গোষ্ঠীর কথা— হয়তো দেশভেদেই দুটো নাম— নইলে চরিত্রে একই— নৌটঙ্কি আর নাচনি৷ নৌটঙ্কি বাংলার বাইরে‍— বিহার উত্তরপ্রদেশে আর পশ্চিমবঙ্গে নাচনি৷ তাও প্রধানত দুটো জেলাকে ঘিরে‍—পুরুলিয়া আর বাঁকুড়া৷ এঁদেরও দল আছে, নাচ আছে, সাজগোজ আছে, সংসার নামে একটা নামকেওয়াস্তে ব্যাপারও আছে৷

আগে নৌটঙ্কিদের কথা সেরে নিই৷

এখন তো সস্তা আর হাল্কা হয়ে গেছে নৌটঙ্কি নাচ৷ মানুষ ইজ্জত দেবেই বা কেন? সেজন্যে দূরদর্শনের প্রযোজক টি.সি. চতুর্বেদী একটা তথ্যচিত্র প্রযোজনার সময় এঁদের কথাই ভেবেছিলেন— এটা কি কম ইজ্জতের বিষয়!তাঁদের মা গুলাব বাই ছিলেন খাস কানপুর ঘরানার নৌটঙ্কি৷ হাথরাশ শৈলীটাও মন্দ নয়, কৃষ্ণকুমারী মাথুর তো এই ঘরানারই নাচিয়ে৷

একটা মেলা বসেছে বিহারের কোনও একটা গ্রামে৷ একটা ফাঁকা ময়দানে একটা মেরাপে ঝুলছে শামিয়ানার ঝালর৷ সন্ধে নেমে এসেছে, চারদিকে ঘনায়মান আঁধারের একটা হাতছানি৷ একটা দুটো বা তার চেয়ে বেশি পেট্রোম্যাক্সের আলো বাইরের চারপাশের অন্ধকারকে যেন ঘন-জমাট করে দিয়েছে৷ আশপাশের গ্রাম থেকে এসেছেন বহু মানুষ— পুরুষেরা সংখ্যায় বেশি৷ জোয়ান-মরদ এবং বিগতযৌবন পলিতকেশ প্রৌঢ়রাও৷ বালক-কিশোরের সংখ্যা কম৷ বয়স-ভাঁড়ানো কিশোরেরা অবশ্যই আছে৷

সেই পেট্রোম্যাক্সের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় একটা আসর বসেছে৷ সেই আসরে নাচবেন এক তরুণী৷ আসর আর দর্শকদের গা ঘেঁষে‍ বসেছে বাদকেরা— পাখোয়াজ বা মাদল, একটা সস্তা হারমোনিয়াম এবং একটা তারবাদ্য, ক্লারিওনেটও আছে, এবং ইত্যাদি৷ আসরের মাঝখানে যুবতী নাচিয়ে, খুবসুরত তো নিশ্চয়ই৷ গোটা শরীরে একটা শরীরী আবেদন উচ্চারিত, চটুল চাহনিতে অপরিমিত লাস্য— সমস্ত উপস্থিত পুরুষদের জন্য আঠার মতো আহ্বান৷ ফুলওয়ালি সেজেছে, তার ঘাগরার কুঞ্চনে হিল্লোল, তার গালে পাউডার-রুজের আধিক্য ছাড়িয়ে ঝিকমিক করছে ভুরির অজস্র হিরে‍-কুচি‍-ঔজ্জ্বল্য, রক্ত ওষ্ঠাধর কি প্রাথনা করছে পুরুষের চুমকুড়ি?

গলায় তার গান— অনেক পুরনো গান কিন্তু একেবারে হালফিলের হিন্দি ফিল্মিগানের মোড়কে মোড়া৷ নতুন পাত্রে পুরনো মদ৷ গানের তালে তালে পায়ের ঢালে সে এক আশ্চর্য বোলবোলাও৷ নাড়ির কাঁপন বাড়ায়৷ নাচে অবশ্যই তালিম আছে, সহবত আছে, কুদরতও আছে৷ নইলে শতেক পুরুষ এমন করে তার সমস্ত শরীরে তাঁদের দুটি করে নয়ন নিবেদন করে বসে আছে একই সঙ্গে কেমন করে? সব ছাপিয়ে নাচের দাপানিতে একটা আশ্চর্য শক্তিমত্তা বিচ্ছুরিত৷ অবশ্য আগের নৌটঙ্কিদের দেখা পাওয়া ভার৷ এঁরা বদল হতে হতে একেবারেই বদলে গেছেন৷ এখন সবটাই উচ্ছ্বাসে বিস্ফারিত এবং বলা বাহুল্য শরীরের হাতছানি৷

আসলে নৌটঙ্কি ছিল এক ধরনের থিয়েটারি ব্যাপার৷ তবে অস্বীকার করার উপায় নেই এতে রোমান্স ব্যাপারটা বেশই জোরদার ছিল আর যৌন আবেদনের ব্যাপারটা তো জলভাত৷ হয়তো নান্দনিক ব্যাপারের ছোঁয়া ছিল কিন্তু তা তো পরে একেবারেই বর্জিত৷ এখন ডবকা ফুলওয়ালির পসন্দওয়ালার সংখ্যা সীমাহীন৷

যথাসময়ে আসরে বাজনা বেজে ওঠে৷ ফুলওয়ালির গানের সঙ্গে শরীরের হিল্লোল৷ দর্শকের চোখ প্রতিটি ভাঁজে‍ ভাঁজে‍ বিচরণ করে৷ যত রাত বাড়ে, তত উদ্দামতা৷ দর্শক দরবারে তখন মার্জারধ্বনি, শিস আর সিটি এবং বেবাগা শব্দের তরঙ্গিত অশ্লীলতা!আসরে তখন নিক্ষিপ্ত হচ্ছে টাকার পেলা৷ শরীরে ঢেউ তুলে ফুলওয়ালির আভূমি কুর্নিশ— হাজার চোখে তখন অসম্পৃত শরীরে লেহন৷ টাকা আসছে‍— তাতে ফুলওয়ালির কী! সে তো ম্যানেজারের থলিতে৷ তিনি সগর্বে নাচা-গানা থামিয়ে দিয়ে মহান দাতার নাম ঘোষণা করে দেন৷

এই ফুলওয়ালিরা সাধারণত নাচগান শেখেন তাদের মায়ের কাছে৷ হয় মা, না হয় মাসি বা মাসিস্থানীয়রাই তাদের গুরু৷ ফুলওয়ালিদের কেউ কেউ পড়াশোনা করতে চান৷ কিন্তু সংসার বড় জ্বালা!— অন্নচিন্তাঃ চমৎকারাঃ৷ সংসার আর সরস্বতীকে এক জায়গায় মেলাতে পারেন না তাঁরা৷ তাই অনেক অধরা স্বপ্নের মতো পড়াশোনা করে এগিয়ে যাওয়াটা আর রূপ পায় না৷ তখন এই রূপের হাটের নৌটঙ্কি হওয়া৷ তবে একটা স্বপ্ন প্রায়ই হাতছানি দেয়— তাঁর বৃত্তির সঙ্গেও অনেকটা মানানসই৷ যদি তিনি একটা টিভি সিরিয়ালে অভিনয়ের সুযোগ পান— এজন্যে গ্রাম ছেড়ে লখনউ বা দিল্লি চলে যেতে তিনি এক পা এগিয়ে৷ এমনকী যদি একটা বারে সাকির কাজ পান— মন্দ হয় না তাও৷

বাইজিদের দেখেছি একটা জিনিসের সঙ্গে তাঁরা আপস করতে চান না৷ লোকে খারাপ বলে বলুক, কিন্তু পেশার একটা ইজ্জত আছে বলে তাঁদের ধারণা৷ এই ইজ্জতের জন্য প্রার্থনা তো সব পেশার পেশাদারদের অধিকারে আসতে পারে৷ হলোই বা একটা বিয়ের উৎসবে নাচা-গানা অথবা কোনও মেলায় বা কোনও জলসায়— টাকার প্রয়োজনে তো সব জায়গায় যেতে হয়, কিন্তু তা বলে নিজের ইজ্জতটা একেবারে বিলিয়ে দিতে হবে? একসময় তো নৌটঙ্কিদের ইজ্জত ছিলই৷ নৌটঙ্কি গুলাব বাইকে সারা ভারত সম্মান জানিয়ে পদ্মশ্রী উপাধিতে সম্মানিত করেছিল৷ তিনি তো সঙ্গীত নাটক আকাদেমির পুরস্কার পেয়েছিলেন৷ এঁর দুই মেয়ে আশা আর মধুও দীর্ঘকাল পুরনো ধারার নাচই নেচেছেন কতদিন টেলিভিশন আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্যে৷ তবে তাঁদে‍র পেশার যে অবনমন ঘটে গেছে‍— সে বিষয়ে তাঁরাও অবহিত৷ কিন্তু পুরনো ঐতিহ্যের বিষয়ে শ্রদ্ধাবতী৷ কেমন করে রাজা-রানি, সাধু-সজ্জন, চোর-ডাকাতের গল্প নিয়ে পালা সাজানো হতো— ভাবলোই তাঁদের আনন্দ হত৷ এখন তো সস্তা আর হাল্কা হয়ে গেছে নৌটঙ্কি নাচ৷ মানুষ ইজ্জত দেবেই বা কেন? সেজন্যে দূরদর্শনের প্রযোজক টি.সি. চতুর্বেদী একটা তথ্যচিত্র প্রযোজনার সময় এঁদের কথাই ভেবেছিলেন— এটা কি কম ইজ্জতের বিষয়!তাঁদের মা গুলাব বাই ছিলেন খাস কানপুর ঘরানার নৌটঙ্কি৷ হাথরাশ শৈলীটাও মন্দ নয়, কৃষ্ণকুমারী মাথুর তো এই ঘরানারই নাচিয়ে৷

নৌটঙ্কি গুলাব বাই

 

মায়ের কথা মনে হতেই আশার মনে পড়ে গিয়েছিল আর একট নৌটঙ্কি সুখবদন বাই-এর কথা৷ তিনি বলেছিলেন, গুলাববাই নিজের নামেই ‘দি গ্রেট থিয়েটার কোম্পানি’ খুলে ৫০-৬০ জন লোকের অন্নসংস্থানের ব্যবস্তা পর্যন্ত করে ফেলেছিলেন৷ তাঁর রাজা হরিশ্চন্দ্র পালা আর লায়লা মজনুর পালা নিয়ে গুলাব বাই কত আসর যে মাতিয়ে দিতেন! ১৯৪৫ সালে এর প্রতিষ্ঠা কিন্তু দিনকাল এত দ্রুত বদলে গেল যে, বছর পঁচিশেকের মধ্যে দল চালাবেন কী করে‍— তাই ভেবে অস্থির, রোজগারপাতিও তো দল চালানোর মতো নয়৷ সিনেমার লোকেরা একে তাঁদে‍র শিল্পকে ছিনতাই করে তাঁদের কাজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রচার করেছে বটে, কিন্তু আমাদের পেটে তো হাত পড়ে গেছে৷ তাছাড়া সিনেমা শিল্পটা হালকা করে দিয়েছে, দিয়েছে খেলো করেও৷ শিল্পের চেয়ে বড় হয়েছে শরীর৷ ছিঃ! আসল গানের মৃত্যু হয়েছে চটুল সিনেমার ছুরিকাঘাতে৷ তবুও কিছু তরুণী একে পুরনো মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করেও কয়েক কদম পিছিয়ে যাচ্ছিলেন— ইজ্জত বজায় থাকবে তো?

সংসারধর্ম পালন করে ইজ্জত অর্জন— সেও তো দুরাশা! নৌটঙ্কিরা কি তবে হারিয়ে যাবেন, না অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ছোট হতে হতে একেবারেই কি অন্য পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকবেন?

নৌটঙ্কিরা বঙ্গদেশেও বর্তমান৷ তাঁদের পরিচয়— তাঁরা নাচনি৷ পুরুলয়া আর বাঁকুড়ার বাইরে তাঁদের তেমন করে অস্তিত্ব নেই৷ সত্যি বলতে, পুরুলিয়াতেই তাঁরা বেঁচে‍ বর্তে ছিলেন৷ এখনও আছেন, কিন্তু সে বুঝি শুধু অস্তিত্ব রক্ষা৷ নৌটঙ্কিদের মতো এঁদের কানপুরি বা হাথরাসি ঘরানা নেই৷ নাচনিদের নাচ প্রধানত ঝুমুর নাচ, গানও ঝুমুর সঙ্গীত৷

ঝুমুর হল বাংলার পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে সবচেয়ে পরিচিত আর প্রচারিত গান৷ মূলত সাঁওতাল পরগনা থেকে প্রবাহিত হয়ে এসেছে এর সুর৷ পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিম বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ধলভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর— এমনকী ধানবাদের নানা প্রান্তে৷ ঝুমুর সুরে একটা মনমাতানিয়া আবেশ আছে৷

ঝুমুর শব্দের অর্থ কী তা জানি না৷ ঘুঙুর পায়ে ঝুমুর ঝুমুর নাচে বলেই কি? নাকি ‘ঝুমুরি’ নামে যে একটা লোক-রাগিণী আছে‍— যেখানে নর-নারীর মিলনকথাই প্রাধান্য পায়— তাই থেকেই কি ‘ঝুমুর’ এসেছে‍— জানি না৷ পুরনো কালে ‘ঝোম্বড়াই’ বলে নাকি একটি সুর ছিল— লোক-পণ্ডিতদের একদল বলেন— তা থেকেই নাকি ঝুমুর৷ এটাও জানি না৷ যেটা জানি তা হল এর মন উদাস করা সুরে আর নাচের তালে একটা মন কেমনের হাওয়া পাক দিয়ে মানুষকে উতলা করে তোলে৷ ধামসা আর মাদলের তালে অবরোহে চড়া আর খাদে একটা ভারসাম্য স্থিতি পায় এই গানে৷ আর তাল বৈচিত্র্যে এই নৃত্যবৈচিত্র্য দেখতে পাই— কখনও কাঠি নাচের ঝুমুরে, কখনও বা দাঁড়শালি ঝুমুরে৷ কেউ রস পান টাঁড় ঝুমুরে, কেউ বা ভাদুরিয়া ঝুমুরে৷ নাচও ঝুমুর, গানও ঝুমুর— ঘুঙুর পায়ে ঝুমুর গানে নাচনিদের আজও ওঠে মূর্ছনা আর ছন্দের কল্লোলিত আর হিল্লোলিত দোলা৷

দেবদাসীরা নাচেন, বাইজিরা নাচেন, কিন্তু এঁরা আলাদা একটু, ‘নাচেন বলে নাচনি’ নামেই এঁরা পরিচিত৷ কী তফাত এঁদের বাইজিদের সঙ্গে৷ সাতকাহন করে বলতে না পারলেও পাঁচকাহন করে তাঁদের কথা বলি এখন৷ তাতেই ধরা পড়ে যাবে এঁদের সঙ্গে বাইজিদের ফারাকটুকু৷

নাচনি যাঁর কাছে ঘর করতে এলেন শুধু তাঁরই সম্পত্তি হন— তিনি তাঁর ঘর দেখবেন, সংসার সামলাবেন, নাচবেন, পরপুরুষের আকর্ষণের পাত্রী হবেন, কিন্তু পরপুরুষের স্পর্শ নেবেন না৷ তাঁকে‍ বাঁচিয়ে‍ রাখা বা মরতে দেওয়া— সব অধিকার এই রসিকের৷ এ তো এক ধরনের সন্ত্রাসবাদ৷ এবং এই সন্ত্রাসবাদ চূড়ান্ত হয় তখন, যখন জানতে পারি রসিকের সন্তানটুকু ধারণের অধিকারও তাঁর নেই৷ তাঁকে‍ সন্তানহীনা হয়েই চিরজীবন কাটাতে হবে৷ শুধু তিনি নাচনি, তিনি নারী কিন্তু মা নন! বীভৎস! এবং রসিকের সম্পত্তির কোনও অংশের তিনি অধিকারিণী হবেন না৷

তোমরাশোল গাঁয়ের বিশাল ময়দানে পিপুল গাছটার কাছে ছেলে‍-পুরুষ-নারীরা ভিড় করেছেন এক মোহময়ী রাতে৷ পতপত করে উড়ছে সামিয়ানার ঝালর মেঠো হাওয়ার সঙ্গে খুনসুটি করে৷ রাতটাকে আরও নিবিড় কালো করে জ্বলে উঠেছে গ্যাসলণ্ঠনগুলো৷ এদিকে ওদিকে গাছের ডালে ঝোলানো হয়েছে তালতোবড়া কয়েকটা লাউডস্পিকারের চোঙ, তাতে বাজছে হালফিলের চটুল হিন্দিগান তারস্বরে৷ দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন এসেছেন এই রাতে, এই নাচনিদের রাতে৷

হঠাৎ করে আসরে বেজে উঠেছে মাইকে হিন্দিগান থামিয়ে হারমোনিয়ামের প্যাঁ-পোঁ, তাতে সঙ্গত করছে মাদল বা ধামসা, ক্ল্যারিওনেটের গালফোলানো সুরও একটি সংগতি বিধান করছে৷ হঠাৎ সমস্ত আসর ভেঙে পড়ল একটা আনন্দ হুল্লোড় দিয়ে‍— আসরে নাচনি এসে গেছেন৷ এককালে খুবই ঝকমকে ছিল— এখন রংচটা জর্জেটের দুলদুলি শাড়ির বাহারে, মুখে প্রায় শস্তা প্রসাধনের পুরু প্রলেপ, ওড়নার বাঁধুনি আর ঝিকিমিকি তারার টুকরো মাখা নাচনি এসেছেন— এতক্ষণ তো এরই প্রতীক্ষায় ছিলেন সমবেত রসিকজন৷ ছোটনাগপুর ঘরানার ঝুমুরশৈলীর নাচ পায়ে‍-গায়ে মাখিয়ে৷ কলকাতা থেকে কম-সে‍-কম শ’দুয়েক কিলোমিটার দূরের এই গ্রামে আধুনিকতার ছোঁয়া যে আসেনি তা নয়, কিন্তু এই ঝুমুরনাচের আসরে সেই পুরাতনপন্থী রসিকদের কড়া চোখ পাহারা দিয়ে রক্ষা করে নাচনিদের৷ বাইজিরা নিজেরাই নিজেদের মালিক বাঁধাবাবু থাকলেও৷ নাচনিরা কোনওদিনই নিজেদের অধিকার নিজেরা পান না৷ আসলে নাচনিদের অধিকার বলে কোনও বস্তুই বোধ করি নেই৷

কবে নথ-ভাঙার পর বাইজিরা পরপুরুষের সামগ্রী করে তোলেন নিজেদের৷ কিন্তু নাচনিদের কোনও এক কিশোরীবেলায়, নয়তো নবযৌবনে বাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে এসে ভিড়িয়ে দেওয়া হয়, হয় কোনও রসিকের কাছে, নয়তো অনিকেত এক যৌনপল্লির বাসিন্দা হতে৷ নাচনি যাঁর কাছে ঘর করতে এলেন শুধু তাঁরই সম্পত্তি হন— তিনি তাঁর ঘর দেখবেন, সংসার সামলাবেন, নাচবেন, পরপুরুষের আকর্ষণের পাত্রী হবেন, কিন্তু পরপুরুষের স্পর্শ নেবেন না৷ তাঁকে‍ বাঁচিয়ে‍ রাখা বা মরতে দেওয়া— সব অধিকার এই রসিকের৷ এ তো এক ধরনের সন্ত্রাসবাদ৷ এবং এই সন্ত্রাসবাদ চূড়ান্ত হয় তখন, যখন জানতে পারি রসিকের সন্তানটুকু ধারণের অধিকারও তাঁর নেই৷ তাঁকে‍ সন্তানহীনা হয়েই চিরজীবন কাটাতে হবে৷ শুধু তিনি নাচনি, তিনি নারী কিন্তু মা নন! বীভৎস! এবং রসিকের সম্পত্তির কোনও অংশের তিনি অধিকারিণী হবেন না৷ জীবনে‍-মরণে এমন বঞ্চনা নিয়েই তাঁকে‍ সাজতে হয়, যৌবনবতী থাকতে হয়, বাহ্যত পুরুষের মনোরঞ্জন করতে হয়— আমি জলে নামবো, জল ছড়াবো, তবুও আমি জলকে ছোঁব না৷ এ কী সংযম না নিপীড়ন! রক্ষক ইনি!

নাচনি সিন্ধুবালা দেবী

১৯৯৫ সালে পুরুলিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠা নাচনি সিন্ধুবালার বয়স কিছু না হলেও আশি পার হয়ে গিয়েছিল৷ নারী-পাচারকারীদের হাতে তিনি যখন লুণ্ঠিতা হলেন, তখন কতই তাঁর বয়স— বারো বছরের তন্বী কিশোরী৷ পাচারকারীরা অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে‍ কোথাও বিক্রি করতে পারলে না৷ কারণ তাঁর কপালে একটা উল্কি আঁকা ছিল৷ তাতেই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়, তাই খদ্দের জুটল না৷ কী করবে তবে এই বোঝাটাকে নিয়ে সেই নারীমাংস বিক্রেতার দল৷ তাই তাঁকে‍ তারা ছেড়েই দিলে বিশ্বের বিশাল প্রাঙ্গণের মাঝে৷ অসহায় নারীকে, জানিনা কতজনের লালসার শিকার হতে হয়েছে, অথবা আব্রু বাঁচাতে‍ পেরেছেন কিনা৷ শেষে এক জমিদার তাঁকে‍ র‍ক্ষিতা করে রাখলেন৷ একবার সতীত্ব খোয়ালে স্বামী পাওয়া যায় না, তবে রসিক পাওয়া যায়৷ রসিকটির হয়তো জীবনবোধ ছিল— টানা ছাব্বিশ বছর সিন্ধুবালাকে তিনি রেখে দিলেন৷ সিন্ধুবালা বেঁচে‍ রইলেন তাঁর নাচনি হয়ে৷ তাঁর এন্তেকাল হলেও সিন্ধুবালা নিরাশ্রয় হলেন না, তিনি যে স্বর্ণডিম্ব প্রসবিনী হংস৷ নাচনি হয়ে রোজগার তো কম করেন না৷ অতএব সেই জমিদারের ভ্রাতুষ্পুত্র তাঁর দ্বিতীয় রসিক হয়ে উঠলেন— বয়সে অবশ্য মাত্র ২৬ বছরের ছোট৷ এবং সিন্ধুবালা তাঁরও নাচনি৷ কী এক আশ্চর্য প্রক্রিয়া তাঁরা জানতেন— তাঁদের গর্ভসঞ্চার হতো না, হলেও কদাচিত তা ঘটত৷ বয়সে ছোট হোক, কিন্তু সিন্ধুবালার একটা সান্ত্বনা তো ছিল— তাঁর একজন রসিক আছে তাঁর পাশে৷৷ নইলে বিগতযৌবনাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলার লোকের অভাব তো সমাজে কোনও কালেই ঘটে না৷ হলেই বা প্রৌঢ়া, রসিক মানুষটি টাকার রসের স্বাদ ভালই জানতেন৷

১৯৯৫ সালেও তাঁর নাচনির রোজগারপাতি মন্দ ছিল না৷ তাঁর নৃত্যশিল্প কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের মনোহরণ করেছিল৷ তাঁকে‍ বাঁচিয়ে‍ রাখার অর্থ একটা লোকশিল্পকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা৷ কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে‍ সাহায্য করতেন মাসিক দেড় হাজার টাকা নগদ দিয়ে৷ সে তুলনায় রাজ্য সরকারের সাহায্যরে পরিমাণ নগণ্য— মাত্র মাসিক পঁচিশ টাকা৷ একটা রাত মাত্র নারীপাচারকারীদের সঙ্গে কাটাতে বাধ্য হওয়ার অপরাধে সিন্ধুবালা নাচনি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু ঝুমুর গান আর নাচকে তিনি তাঁর চর্চা-অনুশীলনের বিষয় করে নিয়েছিলেন প্রাণমনে৷ নাচনি হওয়া ছাড়া অবশ্য তাঁর গত্যন্তর ছিল না৷

নাচনি সরলা দেবীর কথা মনে পড়লে দুঃখ রাখার জায়গা থাকে না৷ তাঁর রসিকের সৌজন্যে তাঁর একখানি পুত্রসন্তান জন্মেছিল৷ তাঁর কেমন যেন একটা বিশ্বাস জন্মেছিল যে সন্তানের সুবাদে তিনি রসিকের সম্পত্তির অধিকার পাবেন৷ হায় সরলা বালিকা! তিনি তাই রান্নাবান্না করেন, রাতে রংচং মেখে সাজেন আর নাচেন, আর দিনের বেলায় জমিতে খেতির কাজ করেন৷ এবং পরিণাম অল্পবিস্তর অন্য সব নাচনিদেরও— মালাবতী, বিমলা, সুশীলা বা বুটনদেবীদের৷ সব নাচনিদেরও— মালাবতী, বিমলা, সুশীলা বা বুটনদেবীদের৷ তবে তাঁদের অবস্থা বুঝি একটু উনিশ বিশ৷ রাতে নাচের মুজরো হিসেবে তাঁদের দাবি একটু বেশি‍— আড়াই থেকে তিন হাজার৷ তাঁদের গানের ক্যাসেট বের হয়েছে যে৷ স্থানীয় মানুষ তাঁদের নিয়ে‍ একটা ব্যবসরা ফেঁদে বসেছেন— এঁদের ক্যাসেট তৈরি করে নিয়ে বছরে হাজার দুয়েক ক্যাসেট বিক্রি করেছেন এক সময়ে৷ নাচনিদের গানের ক্যাসেটের বেশ একটা ভাল বাজার তিনি পেয়েছিলেন একদা৷ তাই এককালীন দেড় থেকে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি নাচনিদের গানের ক্যাসেট তৈরি করে ফেলতেন৷

নাচনি পোস্তুবালা কর্মকারের রসিক বিজয় কর্মকারের বয়স তেত্রিশ— তাঁর চেয়ে বছর আষ্টেকের বড়৷ বিজয় নিজে গাইতেনও ভাল৷ তাই যুগের দাবি মেনে তাঁর নাচনির সঙ্গে হিন্দি গানের মিশেল দিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো ক্যাসেট করে বাজারটা নিজেই ধরে বসেছিলেন৷ সেটাই ছিল যুগের চাহিদা৷ চাহিদা মেটাতে গিয়ে শিল্পটাই হারিয়ে যায়৷ তা কি পোস্তুবালারা ভাবছিলেন— সম্ভবত না৷ বাঁচার তাগিদটা সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়৷ তার উপর নাচনির যন্ত্রণা ভিন্নতর৷ রসিক তাঁকে‍ ভোগ করবেন, কিন্তু বিয়ে করবেন না৷ তাঁর মা হওয়ার উপায় নেই৷ নেচে‍-গেয়ে মানুষ ভুলিয়ে গভীর রাতে যখন বিছানায় শুয়ে পড়েন, তাঁদের ঘুম আসে না, একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা গুমরে ওঠে বুকের ভিতর৷ যাঁরা আসরে বসে শুধু চিৎকার করে বলেন— আরও, আরও চাই আমাদের— এদিকটা ঘুরে, একটু মাথা ঝুঁকিয়ে‍, ঘাগরাটা ঘুরিয়ে, তাঁরা কী করে জানবেন মা হতে না পারার যন্ত্রণাটা, পরগাছা হয়ে বেঁচে‍ থাকার বেদনাটা কিছুতেই পরিমাপ করা যায় না৷

এটা পরিমাপ করার জন্যে কিনা জানি না— এঁদের কথা সরকারের নজরে আসে৷ দূরদর্শনের পক্ষ থেকে নাচনিদের নিয়ে একটা তথ্যচিত্র তৈরির উদ্যোগ দেখা দেয় ১৯৯৭ সালে৷ আগুনলাগা পলাশগাছের খাসবাসর পুরুলিয়ার সটরার বনে এর শ্যুটিং শুরু হয়৷ এর পরিকল্পনা দূরদর্শনের পোড়খাওয়া প্রদ্যোৎ সমাদ্দারের৷ এঁকে অনেকেরই মনে রাখার কথা৷ ১৯৯৬ সালে হেমা মালিনীকে দুর্গা সাজিয়ে তিনি মহালয়ার অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন৷ কর্তৃপক্ষের কাছে দরবার করে অনুমতি নিয়ে তিনি চিত্রনাট্যকার, ক্যামেরাম্যান আর তথ্যচিত্রের পরিচালিকা সুদেষ্ণা রায়কে নিয়ে পুরুলিয়া চলে আসেন৷ এঁরা বাইজি নন— বাবুদের জন্য এঁরা নাচেন না৷ নাচনিরা গ্রামাঞ্চলের নাচিয়ে৷ তাঁদের গান লোকভিত্তিক, নাচও তাই৷ তখনও বেঁচে‍ সিন্ধুবালা দেবী৷ তাঁর রসিকের দাদার নাতিকে দত্তক নিয়ে খানিকটা স্বস্তিতে আছেন নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সেও৷ বিমলা, লক্ষ্মী, পোস্তুবালা আর বাসন্তীকে নিয়ে আসর সাজিয়ে ছবি তোলার আয়োজন৷

এঁদের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও নাচনিদের নিয়ে তথ্যচিত্র করতে এগিয়ে আসেন শিবকুমার আগরওয়াল ও সুতপা ঘোষ৷ এঁদের জীবনের যে ছবি‍— রঙ্গের ও বেদনার আমরা এঁকে‍ এসেছি‍—তাকেই সেলুলয়েডে বেঁধে‍ রাখার চেষ্টা৷ যেটা বলিনি সেটা যে কত ভয়াবহ তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে৷ বেঁচে‍ থাকার জীবনের পরেও একটা জীবন থাকে‍— তা মৃত্যুকে ঘিরে নিঃশব্দে গড়ে ওঠে৷ কোনও নাচনি যখন মারা যান তাঁর মৃতদেহ দেখতেও আসেন না তাঁর রসিক— যার কথা ভেবে নাচনি তাঁর সিঁথিতে‍ সিঁদুরের রেখা টানেন৷ তাঁদের শবদেহ গ্রামের বাইরে ফেলে দেওয়া হয়৷ একটা গোরুর গাড়ির শেষে পায়ে দড়ি বেঁধে‍ শবদেহ মাটিতে ফেলে হিঁজরোতে হিঁজরোতে টেনে নিয়ে তাঁকে‍ গ্রামর বাইরে শ্মশানের কাছে ফেলে দেওয়া হয় সোল্লাসে৷ রসিক মানুষের এমন রসিকতা দুনিয়ায় শুনেছেন কেউ?

এবং গোদের ওপর বিষফোড়া! মাওবাদীরা গয়া, চাতনা, ঔরঙ্গাবাদ, পালামৌ, হাজারিবাগে নাচনিদের হুমকি দিয়েছিল ১৯৯৬ সালে‍— এসব মনোরঞ্জন বন্ধ কর, নইলে বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস! এই হুমকি নাকশালরাও দেয় বারাণসী, উত্তরপ্রদেশে৷ যুক্তি‍— নাচনি নাচানো হলো সামন্ততান্ত্রিক প্রথা৷ অতএব বন্ধ হোক৷ ধন্যবাদ মোরগাতির বিডিওকে‍— তিনি রক্তচক্ষু না মেনে এঁদের বাঁচিয়ে‍ রাখার জন্য মুজরোর ব্যবস্থা করেন৷ নাচনি শব্দের অর্থ কি তবে লড়াই করে বাঁচা!

এরপর দ্বিতীয় পর্ব  

 

শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা ১৪২১

লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হল